শিক্ষার হেরফের

শিক্ষার হেরফের

by Abdullah Al Mim -
Number of replies: 0

সাধারণত মানুষ নিজের কালের সমাজজীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে না। আবার অনেকে পরচর্চা করে সুখ পায়। বক্তব্য অনুকূলে থাকলে শ্রোতাও সে সুখ ভাগ করে নেয়। তবে ভুল শুধরে দিয়ে নিজে সৃষ্টি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে কজন? বাঙালির সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাভাবনাকে শুধু কাগজ-কলমে রূপ দেননি, হাতে-কলমেও দেখিয়ে গেছেন। আমরা তার বিস্তারিত সন্ধানে যাব না। একটি মাত্র পত্রকে আলোচনার উপজীব্য হিসেবে উপস্থাপন করব।


রবীন্দ্রনাথের জন্মের দুই বছর পর ১৮৬৩ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভুবনডাঙ্গায় একটি ব্রহ্মাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। কালক্রমে সেটি আশ্রম বিদ্যালয় ও পরে ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। আজকের দিনে যার পরিচয় শান্তিনিকেতন।


শান্তিনিকেতনে আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক নিয়োগ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যেসব মতামত পোষণ করে গেছেন, আমরা তা ফিরে দেখব।


রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল অনেকটা মতবাদমুক্ত। জীবনকেন্দ্রিক বিষয়ের সেখানে প্রাধান্য ছিল। শুধু তাত্ত্বিক বা কেতাবি জ্ঞান নয়; হাতে-কলমে কিছু কর্মমুখী শিক্ষারও সংযোজন ছিল সেখানে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে শিক্ষক নিয়োগ সম্পর্কে। আমরা যে পত্রটি সম্পর্কে উল্লেখ করেছি তাকে তখনকার আশ্রম বিদ্যালয়ের অঘোষিত গঠনতন্ত্র মনে করা হতো। চিঠিখানা প্রখ্যাত পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর জামাই কুঞ্জলাল ঘোষকে লেখা। তিনি শান্তিনিকেতনের প্রথম দিককার নিষ্ঠাবান শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম। রবীন্দ্রনাথ ১২-১১-১৯০২ তারিখে তাঁকে দীর্ঘ ২০ পৃষ্ঠার একখানা পত্র লেখেন। পত্রের সূচনা করেন এভাবে, ‘আপনার প্রতি আমি যে ভার (শিক্ষকতার) অর্পণ করিয়াছি আপনি তাহা ব্রতস্বরূপ গ্রহণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, ইহাতে আমি বড় আনন্দ লাভ করিয়াছি। ’ লেখা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে বিশ্বাস করতেন, চাকরি হিসেবে নয়। এই শিক্ষাব্রতের কর্মযজ্ঞে প্রথম থেকেই শামিল ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল, ক্ষিতিমোহন সেন প্রমুখের মতো কর্মযোগী ব্যক্তিরা।


রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন লেখাপড়ার উদ্দেশ্য হলো মননশক্তি বাড়ানো। কিন্তু তিনি বিশ্বভারতীর সাথে যুক্ত করেন শ্রীনিকেতন নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে। এর লক্ষ্য হয় কৃষির উন্নয়নের মাধ্যমে পল্লীর উন্নয়ন। এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগৃহীত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এর প্রথম পরিচালক ছিলেন লেনার্ড কে এল্মহার্স্ট। রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতন স্থাপন করেছিলেন ১৯২২ সালে। এটাকে ঠিক বিশ্বভারতীর অংশ বলা যায় না। কারণ, এখানে বিদ্যাদানের ব্যাপারে অনুসরণ করা হতো এবং এখনও হয় পাশ্চাত্য পদ্ধতিকে; বিশ্বভারতীর মতো তপবনের পরিবেশে নয়। অবশ্য বিশ্বভারতীর সেই আদি তপবনের পরিবেশ এখন আর নেই। বিশ্বভারতী চলেছে প্রধানত রবীন্দ্রনাথের কালীগ্রামের জমিদারির আয় থেকে। কিন্তু কালীগ্রামের কৃষক প্রজারা এর দ্বারা কোনোভাবেই উপকৃত হতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ ১১ বার বিশ্বভ্রমণ করেছেন। তারও অর্থ জুগিয়েছে প্রধানত কালীগ্রাম। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তার এই জমিদারিতে মনে রাখারা মতো কিছু করেননি। তিনি তার প্রজাদের শিক্ষিত করে তুলতে চাননি। ভেবেছেন কৃষক প্রজারা শিক্ষিত হলে বাড়বে কৃষক প্রজার অসন্তোষ। কঠিন হবে জমিদারি রক্ষা। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল জমিদার হিসেবে খুবই প্রজা-পীড়ক। এদের প্রজা-পীড়নের খবর ছাপান কাঙ্গাল হরিনাথ, তার ‘গ্রামবার্তা’ পত্রিকায়। যা পড়ে ক্ষুব্ধ হন রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ভাড়াটে গুণ্ডা নিযুক্ত করেন কাঙ্গাল হরিনাথকে খুন করার জন্য। কিন্তু সফল হতে পারেন না।